পথেপ্রান্তরে ছড়ানো নিত্যদিনের গুজব
-------------------
শেখ হাবিব বাবু
এক ব্যক্তি সি এন জি থেকে নেমে ৩০টাকার ভাড়ার জন্য ৫০০/নোট দিল,দেখা গেল আরও হাজার টাকা নোটের কড়কড়া নোট,হাতে বিদেশী ফলের ব্যাগ,দামী মোবাইল,দামী পোশাক,দামী জুতা কিন্তু পড়াশোনা তেমন একটা না থাকলেও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ --
লোক: কি যে একটা অবস্থা,দেশটা শেষ হয়ে গেল,দেশটাকে কোথায় নিয়ে খাড়া করছে সরকার,পাঁচশ টাকার ভাংতি নাই।
সিএন জি ড্রাইভার: ভাই,কি কমু,সকাল থেকে বেশির ভাগ পেসেঞ্জার খালি পাঁচশ টাকা দুইশ টাকা কেউ হাজার টেহার নোট দেয়,দেশের কি যে একটা অবস্থা।
সি এন জি ড্রাইভার আমার পরিচিত, কানে কানে আমাকে বলল,ভাই,দেশের কি হবে?
মেজাজটা অনেক কষ্টে ঠান্ডা রেখে বললাম,দেশের আবার কি অবস্থা,ভাল অবস্থা!
তুমি হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করলা?
সি এন জি ড্রাইভার :না মানে বলছিলাম কি দেশের কি অবস্থা?
এবার মেজাজ আর ঠিক রাখতে পারলাম না,বললাম,কি বাজে আলাপ করতাছ, তোমার কি অবস্থা?
ড্রাইভার : আমার অবস্থা মোটামুটি ভাল,
আমি: মিয়া খুব পাকনামি কর, না!প্রতিদিন কত আয় কর?
ড্রাইভার : ভাই,কোন দিন ১২শ,কোন দিন ১৪/১৫ শ!
আমি: তাহলে কেন এই বাজে বকছ যে,দেশের কি অবস্থা! একটু আগে তুমিই বললা মানুষের কাছে খালি বড় নোট,আবার তুমিই প্রশ্ন করলা দেশের কি অবস্থা!
ড্রাইভার: (একটু গালি দিয়ে)ভাই,কিছু শালার পুতাইত আছে সি এন জিতে বইসাই শুরু করে দেশটা নাকি শেষ অইয়া গেছে,অথচ শালাগো এক সময় বাড়িতে ঘর ছিল না,খালি পায়ে চলত,খেতের লাইলে(আইল) খাগত(পায়খানা) আর এখন বাড়িতে বিল্ডিং, দেশি বিদেশি ফল খায়, খায়তে খায়তে মরতাছে আর সারাদিন সরকারের বদনাম!
আমি: তাহলে বুঝ,এগুলিরে ভুতে কিলায়!
ড্রাইভার: আরে না ভাই,এখন বুঝতাছি এরা পরিকল্পিত সরকারের বদনাম ছড়াচ্ছে,পাঁচশ টেকার ভাংতি নাই সরকারের দোষ,জ্যাম লাগলে সরকারের দোষ,পেটে ব্যথা করলেও দেহি(দেখি) সরকারের দোষ দিতে চায়,,একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে শেষ করল।
ইতোমধ্যে আমি বিশ্বরোডে এসে নামলাম।
প্রতিদিন আমি সকালে বাসে বা সি এন জিতে কর্মক্ষেত্রে আসি,পাব্লিক বাসে ঠিক একই চিত্র একই কথোপকথন শুনি।
একদিন বাসের ভাড়া নিয়ে কন্ডাকটর এর সাথে দুই তিনজন যাত্রীর ভাড়া নিয়ে বসচা হল,দোষ গেল সরকারের কাঁধে।পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক তিতাস গ্যাসে চাকুরি করেন,গলায় সরকারি পরিচয় পত্র ঝুলানো অবস্থায় সে সরকারকে এক হাত নিলেন--এই বার আর চুপ থাকতে পারলাম না,সে বলল,দেশ শ্রিলংকা হতে আর বাকি রইল কয়! আমি বললাম,মাসে বিশাল অংকের সরকারি বেতন পান,বোনাস পান,বাসের ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করে সরকারের দোষ দেন,মিয়া, বেতন কি কোন মাসে বন্ধ হয়ছে? বলল,না।
তাহলে এইসব ফালতু কথাবার্তা বাসে ছড়াচ্ছেন আর সরকারের বেতন খেয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন!এই বার একটু থেমে গিয়ে বিড়বিড় করল।
কিছু দিন আগে ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছি,তখন সম্ভবত পদ্মাসেতু উদ্বোধন হয়ে গেছে,পক্ষে বিপক্ষে সমালোচনা আলোচনা চলছে,
আন্তঃনগর ট্রেনে দুইতিন জন শুরু করল বিরোধীতা,একেএকে সবাই সরকার উদ্ধার করল,দেশের এত উন্নয়ন কি দরকার,রাস্তাঘাট প্রয়োজন নাই,পদ্মাসেতুর প্রয়োজন নাই,ট্রেন এসে নরসিংদী থামলে পাশেবসা আধুনিক হুজুর তীব্র বিরক্ত বোধ করে বলল,ট্রেন কেন তাড়াতাড়ি যাচ্ছে না,এই সেই আগড়বাগড় করে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার করল।
এইবার আমি চুপ থাকতে পারলাম না,বললাম,আপনিই বলছেন উন্নয়ন দরকার নাই,আবার তাড়াতাড়ি ঢাকায় যেতে চান উচিৎ ভাড়া না দিয়ে টিটিকে কিছু ধরিয়ে পারপেয়ে গেলেন,,এবার তিনি চুপ মারলেন।
এবার সিলেটী ভাই বললেন,শুধু কয়েকটি জেলার জন্য এত বড় সেতু করার কি দরকার ছিল,শুধুশুধু টাকা লুটপাট করছে!
আমি বুঝতে পারলাম তার ভিতরে আঞ্চলিক বিদ্বেষ কাজ করছে,বললাম, ভাই আপনি কি করেন?
বলল,আমি সাংবাদিক দিক!
আপনি সিলেট থেকে যদি ট্রেনে যেতে চান আশুগঞ্জ রেলব্রিজ হয়ে যেতে হবে,যদি বাসে যান তাহলেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু (আশুগঞ্জ-ভৈরব সেতু) হয়ে যেতে হবে,যখন সেতু ছিল না ঘন্টারপর ঘন্টা আশুগঞ্জে ফেরিতে আটকে থাকতেন,নিজের বেলা ষোল আনা আর অন্যের বেলা,,, যত্তসব,এবার আমতাআমতা করতে লাগলেন,বললাম,আপনার মত লোকেরাই বলেন দেশ শ্রিলংকা হয়ে যাবে,কয় শ্রিলংকা কি হয়ছে,ফাইজলামি বন্ধ করেন,,এই করতে করতে ট্রেন ঢাকায় এসে গেল!
এবার তিতাস ট্রেনের একদিনের ঘটনা বলি--
আমি ৭০/টাকা দিয়ে টিকেট কেটে কর্নার এর সিটে বসলাম,বিমান বন্দরে আসার পর ট্রেনে উপচেপড়া ভীর,এত কম টাকায় যাতায়াত কল্পনা করা যায়?অনেকেই টিকেট কাটেনা,ফাঁকি দেয়,নরসিংদীর অধিকাংশ যাত্রীকে দেখলাম ভাড়াছাড়া নামল।
এক ভদ্রলোক আমার সিটের পাশে এসে দাঁড়ালেন,আমাকে ঠেস দিয়ে রেখেছে আরেক লোকের একটা বস্তা,সেই বস্তা আমার পায়ের সাথে লাগানো, আর ভদ্রলোক সেই বস্তায় ঠেস দিয়ে পত্রিকা পড়ছে,অথচ বস্তার ভাড় আমার শরীরের উপর পড়ছে।কিছুই বলিনি।
হাতে তার বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা,টিটি দুইবার ভাড়া চেয়ে গেল দিলনা,হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই বলে উঠল দেশটা শেষ হয়ে গেল,সাথে আরেকজন লোক সদ্য হাসপাতাল থেকে বিদায় নিয়ে হাঁড়িপাতিল গাট্টিপেট্টা নিয়ে শুরু করল সরকারের সমালোচনা,এই বার মামুনুল হকেকে কেন বন্দি করে রাখল এই নিয়ে শুরু করল!
আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না,মনে হল আমি একাই বাংলাদেশে সরকারের পক্ষে,বললাম,ভাই একটু চুপ থাকুন,সরকার কি করল?
এই বার পত্রিকাওয়ালা ভদ্দর নোক বলে বসল--দেশে বাকস্বাধীনতা নেই,মন খুলে কথাও বলা যায় না,আমি বললাম,শুধুশুধু সরকারের বিরুদ্ধে এতগুলো গুজব ছড়াচ্ছেন,কেউ কিছু বলছে না,আবার বলছেন বাক্স্বাধীনতা নেই! চুপ থাকুন,আপনি যেমন আওয়ামীলীগ পছন্দ করেন না,আমিও তেমন জামাত বিএনপি হেফাজত পছন্দ করিনা,আমারও রাইট আছে আপনার মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করা!এই বার চুপ করলেন!
এই ভাবে বাসে,ট্রেনে,চায়ের দোকানে সদ্যোধনী হওয়া লোকগুলো, স্বচ্ছল হওয়া লোক গুলো পথেপ্রান্থরে সরকারের উন্নয়ন ভোগ করেও শুধুশুধু দেশকে শ্রিলংকা বানানোর স্বপন দেখছে!
এই কয়েক বছরে মানুষের আর্থিক উন্নয়ন, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক,আহার, বাসসস্থান সহ ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়া স্বত্ত্বেও এক দল লোকের মনে শান্তি নাই,তারা আসলে কারা,তারা কি চায়?তারা কি বলতে পারবে এই কয়েক বছরে কোন মানুষ না খেয়ে মরেছে?বরং অভার ইটিংএ মরেছে,মানুষ হয়ত তার চাহিদামত সব কিছু পাচ্ছে না,কারণ মানুষের অভাব বা চাহিদার কোন শেষ নাই,সোনা দিয়ে মোড়ানো আইস্ক্রিম খায়,জিলাপি খায়,বছরে দশ/বিশ হাজার কোটি টাকার আপেল,মালটা আঙ্গুর খেয়েও এখনো জিজ্ঞাস করে দেশে কি হবে?
আজকে বিকাল আড়াইটার দিকে আশুগঞ্জ গোলচত্ত্বর থেকে রয়েল এসি বাসে উঠলাম,আমার সিটের পাশের সিটে একজন পাগড়ি ওয়ালা বড় হুজুর,সাথে ১৯/২০ বছরের এক মাদ্রাসার তালেবে এলেম,গুণগুণ করে ছাত্রটাকে বুঝাচ্ছে,একপর্যায়ে মুসা নবীর ঘটনার সাথে ফেরাউনের কাহিনী শুনাল--ছাত্রটিকে বুঝাচ্ছে ফেরাউন জানত মুসা সত্য নবী কিন্তু মানত না,আমি শুনে যাচ্ছি,এবার বলল--শেখ হাসিনাও আলেম চিনে কিন্তু মানে না!!
এবার আমি তার দিকে একটু তাকালাম--বুঝতে পারছে তার কথার আমি নীরব প্রতিবাদ করছি,আমি তাকে( হুজুরকে) জিজ্ঞাস করতে চাচ্ছিলাম আলেম কারা,,প্রধানমন্ত্রী আলেমদেরকে সম্মান করছে,নতুন ৫৬৪টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করে আলেমদের নিয়োগ দিচ্ছেন,কওমিদের চাকুরীর সুযোগ দিচ্ছেন,তাহলে সে কোন ধরণের আলেমকে বুঝাচ্ছে--সুন্নী,ওয়াহাবী,ভাণ্ডারী, মাজারপন্থী,মওদুদী পন্থী, হেফাজতী,জামাতী --আসলে জিজ্ঞাস করতে চেয়েছিলাম আলেম আসলে কারা--যারা অন্যের দান খয়রাতে জীবীকা নির্বাহ করে,ওয়াজ করে টাকা কামাই,ইমামতী করে, লজিং থেকে অন্যের গলগ্রহ হয়ে জীবন নির্বাহ করে,নবীকে হাজির নাজির মানে,যারা মানে না,ইদে মিলাদুন্নবী মানে-মানে না,মাজারে যাওয়া ভাল-ভালনা,মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে বলাৎকার করে,ইয়াজিদকে মানে-মানেনা,ইত্যাদির মধ্যে আলেম আসলে কারা???জানি সে উত্তর দিবে যারা আওয়ামীলীগের বিরোধীতা করে তারাই একমাত্র আলেম--তা নাহলে আজ সে বাসে বসে অযথা কেন ছাত্রটিকে কুপরামর্শ দিচ্ছে আর সরকারের বিরোধীতা করছে!!
সবকিছু মিলিয়ে
আমি বলি,ভাই,দেশ সোনার বাংলা হবে কিন্তু মানুষগুলো কেবল অমানুষ থেকে যাবে--কারণ শরীরের অসুখ ঔষধে গেলেও কুঅভ্যাস দূর করার ঔষধ এই জাতি কোন দিন পাবে না!
0.0 / 10
|